যেভাবে শত্রুমুক্ত হয় সাতক্ষীরা
পাকিস্তানি পতাকায় অগি্নসংযোগ, শত্রুবাহিনীর অস্ত্র লুট, ব্রিজ ও ব্যাংকে অপারেশন করে ৭ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়েছিল সাতক্ষীরা। ১৯৭১-এর এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে দখলদার বাহিনী সাতক্ষীরা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। গৌরবের এই দিনে যুদ্ধাহত মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিল। সাতক্ষীরার প্রথম শহীদ আবদুর রাজ্জাক, শহীদ নাজমুল হোসেন, এরশাদ খানসহ অসংখ্য যোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিলেন সেদিন। বিনেরপোতা ব্রিজ ধ্বংসসহ অর্ধশত গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করেছিল এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা। শহরের প্রাণসায়ের খাল পেরিয়ে বিদ্যুৎ অফিসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে শত্রুর ঘাঁটিতে আক্রমণ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন।
তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সেক্টর গড়ে ওঠেনি_ আর যখন অষ্টম ও নবম সেক্টর গড়ে উঠল তখন ওই সেক্টরের প্রথম ক্যাম্প গঠিত হয় ভোমরা স্থলবন্দরে। শুরু থেকেই এখানে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। তৎকালীন ইপিআর-এর সহযোগিতায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয় এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৯ এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময়ে পাকবাহিনীর কয়েকজন প্রাণ হারায়। বীরোচিত যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে নভেম্বর মাসেই শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। আর ডিসেম্বরের ৭ তারিখে মুক্তিযোদ্ধা মুহিদ খানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী দল ধুলিহর ইউনিয়নের বেজেরডাঙ্গায় গেরিলা অপারেশন পরিকল্পনা করে। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে আরেকটি দল ঢুকে পড়ে সাতক্ষীরা শহরে। পাকবাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণে পিছু হটে।
দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুরে যে মহাপরিকল্পনা করে পাকবাহিনীর ব্যুহ ভেদ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা ফাঁস হয়ে যায়। এ সত্ত্বেও মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা সেদিন তাদের অস্ত্র দিয়ে শত্রুসেনাদের পাল্টা জবাব দিয়েছিল। নবম সেক্টরের সদর দফতর টাকি থেকে তিনটি পৃথক গ্রুপ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়ে শহরে। টাকির ঠিক বিপরীতে টাউন শ্রীপুর এলাকায় অবস্থান ও টহলরত পাকসেনাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে একটি গেরিলা গ্রুপ তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অপরদিকে শত্রুদের গুলিতে শহীদ হন কাজল, খোকন, নারায়ণসহ ৭ মুক্তিযোদ্ধা। বীরত্বপূর্ণ এ যুদ্ধে ব্রাশফায়ারে বেশ কয়েকটি গুলি বিঁধে যায় এরশাদ খান হাবলুর দেহে। পরে তিনি মারা যান। হানাদার বাহিনীর অন্যতম খুঁটি মহকুমা হাকিম খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার, তার অফিসের পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে অগি্নসংযোগ এবং বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন। ট্রেজারি থেকে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহসহ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কামরুল ইসলাম খান রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এই সেক্টরে যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন আইয়ুব আলী, স ম অলিউদ্দীন, সালাম, হাবলু, কামরুজ্জামান, এনামুল হক বিশ্বাস, গনি, রশিদ, আজিবর, খসরু, হাসনে জাহিদ জজ, মুজিবর, মোস্তাফিজ, স ম বাবর আলীসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা।
সাতক্ষীরা শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ ও ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানপন্থি আতিয়ার চেয়ারম্যান। তার গুলিতেই শহীদ হন আবদুর রাজ্জাক। তার নামে সাতক্ষীরায় গড়ে উঠেছে শহীদ আবদুর রাজ্জাক পার্ক। সাতক্ষীরা মুক্তির অগ্রণী নায়ক ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টার, আলাউদ্দিনসহ অনেক যোদ্ধা আজ লোকান্তরিত। সীমান্তবর্তী এই জেলা বাংলাদেশের পতাকা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে_ অথচ এত বছর পরও তাদের নামে কোনো স্মৃতিফলক গড়ে ওঠেনি।
[বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডিসেম্বর ০৭, ২০১০]
Related Posts
হোম সাতক্ষীরা, একটি স্বপ্নের শুরু
এডমিন ডেস্ক থেকে হোম সাতক্ষীরা একটি স্বপ্ন, একটি স্বপ্নযাত্রার সূচনা । আমরা (আপনি সহ)Read More
Beautiful Bangladesh, School of Life
বিউটিফুল বাংলাদেশের নেপথ্য কাহিনি (গতকালের প্রথম আলো থেকে) বাংলাদেশকে নিয়ে একটি প্রামান্য চিত্র তৈরী হবে।Read More
সাতক্ষীরা আমার অহংকার
রোজ বাবু ( @rosebabu ) ভাইয়া আমার একটা ম্যাসেজের প্রতিউত্তরে যেটি লিখেছেন তার অনুমতি নিয়েRead More
3 Comments to যেভাবে শত্রুমুক্ত হয় সাতক্ষীরা
Leave a Reply
For Posting a Comment You must be Logged In.
অনেক ধন্যবাদ । মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আরোও লেখা পড়তে চাই।
ভাবতে ভালই লাগছে যে সাতক্ষীরা ১৬ তারিখের অনেক আগেই শত্রুমুক্ত হয়।
আসলে শুধু এই বীর সন্তানদের নামে তো দুরের কথা, সাতক্ষীরায় মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি ফলকই নেই, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।