সাতক্ষীরা জেলার পটভূমি ও ইতিহাস

জেলার পটভূমি

সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ প্রসংগে কয়েকটি মত প্রচলিত। এর মধ্যে প্রধান মতটি হ’ল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক কর্মচারী বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী নিলামে বুড়ন পরগণা কিনে তার অন্তর্গত সাতঘরিয়া গ্রামে বাড়ী তৈরী করেন। তাঁর পুত্র প্রাণনাথ সাতঘরিয়া অঞ্চলে উন্নয়ন কাজ করে পরিচিত ও প্রতাপান্বিত হন। সাতক্ষীরার মহকুমার প্রকৃত জন্ম হয় ১৮৫২ সালে যশোর জেলার চতুর্থ মহকুমা হিসেবে এবং কলারোয়াতে এর সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। প্রথম মহকুমা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নবাব আব্দুল লতিফ। ১৮৬১ সালে মহকুমা কার্যালয় সাতঘরিয়া তথা সাতক্ষীরাতে স্থানান্তর করা হয়। ইতিমধ্যেই সাতঘরিয়া ইংরেজ রাজকর্মচারীদের মুখেই সাতক্ষীরা হয়ে গিয়েছিলো। তাই পুরানো সাতঘরিয়াই বর্তমানের সাতক্ষীরা।

সাতক্ষীরার ইতিহাস

বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান। এ জনবসতি প্রাচীনকালে খ্যাত ছিল বুড়ন দ্বীপ নামে। এর পাশে চন্দ্রদ্বীপ, মধুদ্বীপ, সূর্যদ্বীপ, সঙ্গদ্বীপ,জয়দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপ খ্যাত ছোট ছোট ভূখণ্ডের অবস্থান পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাস ও মানচিত্রে। ঠিক কোন সময় থেকে বুড়ন দ্বীপে সমাজবদ্ধভাবে মানুষের বসবাস শুরু হয় তার বিস্তারিত ও সঠিক তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। রামায়ণ মহাভারতের তথ্যানুযায়ী এ অঞ্চলের সংঘবদ্ধ মনুষ্য বাসতির গোড়াপত্তন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্ব থেকে।মহাভারতের তথ্যানুযায়ী মুনি কপিল পাইকগাছার কপিলমনিতে একটি কালিমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে পূজা দেন। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং পূজা দেওয়ার কাজটা তিনি করেছিলেন মহাভারতের যুগে। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সনে। তাঁর ভারত আক্রমণের সময় গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি নামের একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাটি ছিল এ রাষ্ট্রের অধীন। আলেকজান্ডারের পর মৌর্য ও গুপ্ত যুগে বুড়নদ্বীপ ছিল পুণ্ড্রভুক্তির অন্তর্গত। বুড়নদ্বীপ এ সমেয় পরিচিত ছিল খাড়িমণ্ডল নামে।চন্দ্র বর্মণ খাড়ি অঞ্চল দখল করেনেন চতুর্থ শতকে। এর পর বৌণ্যগুপ্ত (৫০৭-৫২৫) দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার স্বাধীন নরপতি হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। সপ্তম শতকে শশাঙ্ক, ভদ্রবংশ, খরগোরাত ও লোকনাথ বংশ রাজত্ব করছিলেন এ জনপদে। রাজা শশাংক ছিলেন ইতিহাস খ্যাত নরপতি।

সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে খুব সম্ভবত অত্র জেলা গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের কর্তৃত্বাধীনে আসে। বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন শশাঙ্ক। তিনিই বাংলার প্রথম শাসনকর্তা যিনি শুধু বাংলা নয় বরং বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত তাঁর সার্বভৌমত্ব বিস্তৃত করেছিলেন।
homesatkhira
রাজা শশাঙ্ক নিজে রাজ্যকে শুধু ভৌগোলিক অবস্থানে সুদৃঢ় করে ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বেশ কয়েকটি রাজ্য দখল করেন ও বৃদ্ধি করেন নিজ রাজ্যের সীমানা। পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (খ্রিঃ ৬৩৪) যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত দিয়েছেন তাতে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ পওয়া যায়। এর সময়ের গঙ্গারিডি পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, কজংগল, তাম্রলিপ্তি, সমতট প্রভৃতি নামে খ্যাত ছিল। ‘বর্তমানের সাতক্ষীরা জেলা এই সমতটেরই অংশ’।
homesatkhira

অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় পাল ও বর্মণ রাজারা শাসন করেন বুড়নদ্বীপ। তাঁদের আমলে সভ্যতা, সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ইতিহাস খ্যাতি লাভ করেছে বৌদ্ধ ইতিহাস ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি নামে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পাল আমলে দশম শতকে দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাজা ছিলেন চন্দ্র বংশের রাজা ত্রৈলক্য চন্দ্র ও শ্রী চন্দ্র (৯৩০-৯৫৭)। চন্দ্র রাজের সময় দক্ষিণ বঙ্গ ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চন্দ্রবংশের নৃপতিরা বেশ কিছুকাল জনপ্রিয় শাসক ছিলেন এ জনপদে। শ্রী চন্দ্রের পর কল্যাণ চন্দ্র (৯৭৫-১০০৩ খ্রিঃ), লড়হচন্দ্র (১০০০-১০২০ খ্রিঃ), তার পরবর্তী রাজা গোবিন্দ চন্দ্র (১০২০-১০৪৫খ্রিঃ)। চন্দ্র বংশের সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী রাজা হিসেবে গোবিন্দ চন্দ্র ইতিহাস খ্যাত। তিনি চোল রাজ রাজেন্দ্র চোলের কাছে পরাজিত হলে দক্ষিণ অঞ্চলের শাসন ভার চলে যায় পাল বংশের হাতে।

একাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে পাল রাজারা দাপটের সাথে দক্ষিণ অঞ্চলে নিজেদের শাসন কাজ পরিচালনা করেন মহীপাল (৯৯৫-১০৪৫), তৃতীয় বিগ্রহ পাল (১০৫৮-১০৭৫), দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০খ্রিঃ), রামপাল (১০৮২-১১২৪ খ্রিঃ) প্রমুখ। পাল রাজাগণ ছিলেন ইতিহাসখ্যাত নৃপতি।
ইতিহাস খ্যাত কৈবতর্ক বিদ্রোহ হয়েছিল একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। রামপাল এ সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে উত্থান ঘটে বর্মদের। এ বংশের খ্যাত পুরুষ ব্রজবর্ম। পরে তাঁর পুত্র জাতবর্ম বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে সার্বভৌমত্ব অর্জন করেন। কলচুরি রাজকর্ণের একখানি শিলালিপিতে (১০৪৮-১০৪৯ খ্রিঃ) উল্লিখিত আছে জাতবর্ম খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজাকে ধ্বংস করেন। জাতবর্ম কেবলমাত্র নিজের বাহুবলে অঙ্গ কামরূপ ও বরেন্দ্রে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করে খুলনা জেলাসহ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্ম বংশের অপরাপর শাসকরা হলেন-হরিবর্ম, সালবর্ম, ভোজবর্ম প্রমুখ। বঙ্গে বর্ম পরবর্তী রাজত্ব শুরু সেন বংশের। সেন বংশের আবির্ভাব সম্পর্কে ইতিহাস দৃঢ় কোন তথ্য দিতে পারে না। এ বংশের তৃতীয় নৃপতি বিজয় সেনের আমলটি খ্যাত একটি সময়। তাঁর শাসনামল ছিল ১০৯৭ থেকে ১১৬০ খ্রিঃ পর্যন্ত। তিনি খণ্ড বিভাজন শোষণ ব্যবস্থার আওতায় এনে প্রচলন করেছিলেন কেন্দ্রীয় শাসন।
Succeeded in supplanting the Varmans from the south-eastern Bengal and the pales from the north and north-western Bengal. Thus Vijay Sena had established the rule of the Senas over the whole of Bengal.
বিজয় সেন ছিলেন শৈব। এছাড়া সেন আমলের যে শিলালিপি ও ফলক পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায় এঁরা ছিলেন চন্দ্র বংশীয় ব্রহ্ম ও ক্ষত্রিয়। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বাগড়ি নামক এলাকায় প্রশাসনিক বিভাগ সুদৃঢ় করেন। বাগড়ি অঞ্চলের পরিচয় ও উৎপত্তি বিষয়ে জানা যায়-
“উপবঙ্গ নদী ও জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন ছিল। বোধ হয় বাগুরি বা বাউরি জাতির নামানুসারে বাগড়ি নাম হইয়াছে। উপবঙ্গের গঠন-কালে বারংবার আগ্রেয় উৎপাত ঘটিয়াছিল। কলিকাতা অঞ্চল খনন করিয়া দেখা গিয়াছে, সে প্রদেশের অরণ্য, অরণ্য-জন্তুসহ বারংবার বসিয়া গিয়াছিল। বঙ্গ ও উপবঙ্গ, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাদ (মেঘনা) ও গঙ্গার ব-দ্বীপে গঠিত। রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ ও মিথিলা পূর্ব হইতেই ধন-জন-পরিপূর্ণ ছিল; কিন্তু বাগড়িতে মনুষ্যের বাস ছিল না। এই স্থান সমূদ্র গর্ভ হইতে মস্তক উত্তোলন করিতেছিল। আকবরনামায় ইহার ভাটিনাম দেখা যায়। বাগড়ির দৈর্ঘ্য ৫৫০ মাইল ও বিস্তার ৩১২ মাইল। পূর্ব-বিক্রমপুর পদ্মার দক্ষিণে ছিল; যখন ধলেশ্বরী দিয়া পদ্মা প্রবাহিত হইত, অতএব বিক্রমপুর পূর্বে বাগড়ির অন্তর্গত ছিল। এখন ইহা বঙ্গের অন্তর্গত হইয়াছে। বাগড়ির এই অংশই প্রাচীন সমতট”।
রজনীকান্ত বাগড়ি অঞ্চলের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে তিনি এ অঞ্চলকে মোট ১০টি ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো- ১. অন্ধ্রদ্বীপ ২. সূর্যদ্বীপ ৩. মধ্যদ্বীপ ৪. জয়দ্বীপ ৫. চক্রদ্বীপ ৬. কুশদ্বীপ ৭. এডুদ্বীপ ৮. প্রবালদ্বীপ ৯. চন্দ্রদ্বীপ ১০. বৃদ্ধদ্বীপ।
বল্লাল সেন ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে মহাদীক্ষায় দীক্ষিত হন। অদ্ভুতসাগর এর একটি তথ্যানুযায়ী বল্লাল সেন শেষ বয়সে সস্ত্রীক ত্রিবেনীর নিকট গঙ্গা তীরে বানপ্রস্ত অবলম্বন করে অতিবাহিত করেছিলেন। এর অন্য অর্থও করা যায় যে, বৃদ্ধ রাজা ও রাণী স্বেচ্ছায় গঙ্গাগর্ভে দেহত্যাগ করেছিলেন।
লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বের শেষ আমলে রাজ্যে দেখা যায় নানা রকম অরাজকতা। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বলতে গেলে কোন রকম বাধা ছাড়াই অধিকার করেন বাংলা। এ ঘটনার পরও প্রায় দু্‌ বছর জীবিত ছিলেন লক্ষণ সেন। বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণের পর তিনি নদীয়া থেকে নৌকাযোগে পালিয়ে যায় বিক্রমপুরে। স্থানীয় প্রভাবশালী কোমল পাল নামে একজন নৃপতি লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে খুব সম্ভবত খুলনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অধিকার করেন।
বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের সূত্র ধরেই বাংলায় মুসলিম রাজত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তবে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় হতে আরো একশত বছরের মতো সময় লাগে। বখতিয়ার পরবর্তী শাসক আল মর্দান খিলজী (১২১০-১২১২খ্রিঃ) ও গিয়াসউদ্দিন ইওজ খিলজী (১২১২-২৭ খ্রিঃ) দু’শাসকই কর গ্রহণ করতেন রাজাদের কাছ থেকে। ফলে বলা যায় এ সময় পর্যন্ত সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চল পুরোপুরি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এর পরের ২৮ বছর (১২২৭-১২৫৫ খ্রিঃ) এ অঞ্চলের ইতিহাস কোলাহলপূর্ণ। কিছুদিন সমগ্র বাংলা পরিণত হয় একটা প্রদেশে, আবার মুগিসউদ্দীন ইওজবেক এর নেতৃত্বে বাংলা ভোগ করে স্বাধীনতা।
গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনামলে সুন্দরবনসহ বেশ কিছু অঞ্চল তাঁর অধিকারে আসে। তিনি প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা আক্রমণ করে অধিকার করেন ‌এবং সোনারগাঁও অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। এ সময়ে চন্দ্রদ্বীপের (বরিশাল) রাজা ছিলেন কায়স্থ নৃপতি দশরথ দনুজমর্দন দেব।
মুঘল আমলের ছবি

বুঘরা খান (১২৮১-১২৮৭ খিঃ) রুকনউদ্দিন কায়কাউস (১৩০০ খ্র্র্রিঃ) এর সময়ে সাতক্ষীরা অঞ্চল তাঁদের অধিকারে ছিল কিনা তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা জয় করেন। ফলে বলা যায় সাতক্ষীরা অঞ্চল তাঁর রাজ্যসীমার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফখরউদ্দিন মোবারক শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন শাসসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। তাঁর সময় থেকে সাতক্ষীরা অঞ্চল চলে যায় শাহী বংশের অধীনে। ১৩৯৯ থেকে ১৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাতক্ষীরা অঞ্চল ছিল ইলিয়াস শাহের বংশের অধীনে। ১৪১২-১৪৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসন অর্ন্তদ্বন্দ্বে পূর্ণ। ১৪৪২ সালে শাহীবংশের নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ সিংহাসনে বসেন।
দক্ষিণ বঙ্গের মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে যিনি খ্যাত তিনি খানজাহান আলী। এই দরবেশ সেনা দক্ষিণবঙ্গ জয় করেন ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে। কথিত আছে যে, তিনি বাংলার সুলতান নাসিরউদ্দিন শাহের নিকট থেকে একটি সনদে সুন্দরবন থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করে জনপদ সৃষ্ঠি করার অধিকার লাভ করেন।
মুঘল আমলের ছবি

নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের পরবর্তী সময়ে হোসেন শাহী নসরত শাহের সময়েও সাতক্ষীরা ছিল তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত।
কররানী বংশ প্রতিষ্ঠত হয় ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। নানা কারণে এ বংশের শাসকেরা ইতিহাসে বিখ্যাত। কররানী বংশের পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইতিহাসের আলোচিত অধ্যায়। তাজখান এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাসক। তাজখান, তার ভ্রাতা সুলেমান খানের রাজত্বকালে তেমন উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য না থাকলেও সুলেমান খানের দ্বিতীয় পুত্র দাউদখান কররানী এ বংশের আলোচিত শাসক। মাত্র তিন বছরের শাসনামলে (১৫৭৩-১৫৭৬ খ্রিঃ) তিনি অনেক নিকট আত্মীয়কে হত্যা করেন।
মুঘল আমলের ছবি
ঘোড়শ শতকের শেষের দিকে বাংলায় আবির্ভাব হয় বারো ভূঁইয়াদের। কররানী বংশের পতনের পর দক্ষিণাঞ্চলের ভূঁইয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে শ্রীহরি নামের এক ব্রাহ্মণের। তিনি ছিলেন দাউদ কররানীর প্রধান পরামর্শদাতা। শ্রীহরি সুন্দরবন অভ্যন্তরে মকুন্দপুর নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন ও বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করেন। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ধুমঘাট। তাঁর মুত্যুর পর পুত্র প্রতাপাদিত্য রাজ্য সম্প্রসারণে সচেষ্ঠ হন। তিনি কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। প্রতাপাদিত্য ছিলেন সমৃদ্ধশালী ও ক্ষমতাঘর শাসক। বাংলার জমিদারদের মধ্যে প্রতাপাদিত্যই সর্বপ্রথম মুঘলদের আনুকুল্য লাভের জন্য ইসলাম খান এর নিকট দূত প্রেরণ করেন এবং পরে ব্যক্তিগতভাবে মুবহদার এর নিকট আনুগত্য প্রদর্শন করেন। পরে প্রতিশ্রুতি ভাঙার কারণে প্রতাপ বাহিনীর সাথে দুটো যুদ্ধ হয় মোঘল বাহনীর। প্রথম যুদ্ধটি হয় সালকা নামক স্থানে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে। এ যুদ্ধে প্রতাপের পক্ষে নেতৃত্ব দেন তাঁর জৌষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্য ও মোঘলবাহিনীর পক্ষে নেত্রত্ব দেন জামাল খান। মোঘল বাহিনীর সাথে প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় কাগারঘাট ও যমুনার সঙ্গমস্থলে ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এ যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন গিয়াস খানের কিনট। তাঁর শেষ জীবন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। ‘মোঘল বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর সম্ভবত বন্দি অবস্থায় দিল্লি যাওয়ার পথে বেনারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন’।
প্রতাপাদিত্যের পতনের পর খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চল চলে যায় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে। খান-ই-আজম মির্জা আজিজ কোকা (১৮৮২-১৮৮৩ খ্রিঃ) প্রতাপের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের পুরস্কারস্বরূপ মোঘলদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন আমিদপুর, সৈয়দপুর, মুগদাগাছা ও মল্লিকপুরের জমিদারি। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অপরাপর জমিদাররা হলেন ভবেশ্বর রায়, মাহতাব রায় (১৫৮৮-১৬১৯ খ্রিঃ), কন্দর্প রায়, মনোহর রায় (১৬৪০-১৭০৫ খ্রিঃ) ও শ্রীকৃষ্ণ রায় (১৭০৫-১৭৭২ খ্রিঃ)।
সুন্দরবন, সাতক্ষীরা অঞ্চলে প্রতাপাদিত্যের পর ব্যাপক প্রশাসনিক উন্নতি হয় হেংকেলের আন্তরিকতায়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে টিলম্যান হেংকেল প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ নিযুক্ত হন যশোর অঞ্চলে। ঐ বছরেই যশোরে প্রথম আদালত স্থাপিত হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করেন। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে যশোর পৃথক জেলার মর্যাদা পায়। এরপর থেকে যশোর অঞ্চল প্রশাসনিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ হতে থাকে।
সাতক্ষীরা অঞ্চল মহকুমার মর্যাদা পায় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। মহকুমার মর্যাদা পাওয়ার পর প্রথমে সাতক্ষীরাকে যুক্ত করা হয় নদীয়া জেলার সাথে। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া থেকে সাতক্ষীরাকে বিভক্ত করা হয় চব্বিশ পরগণার সাথে। খুলনা জেলার মর্যাদা পায় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। জেলার মর্যাদা পাওয়ার পর লর্ড রিপনের (১৮৮০-৮৪) আন্তরিক প্রচেষ্টায় সাতক্ষীরা মহকুমাকে খুলনা জেলার একটা মহকুমায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মহকুমা প্রশাসকের কার্যাল
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশেরর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় সাতক্ষীরা মহকুমা বাংলাদেশের ৬৪ জেলার একটি জেলা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে এ জেলায় ৭টি উপজেলা, ৮টি থানা, ৭৮টি ইউনিয়ন, ৯৬০টি মৌজা, ১৪২১টি গ্রাম ও ২টি পৌরসভা।
অবস্থানগত দিক দিয়ে দেখলে সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায়। জেলার উত্তর গোলার্ধে নিরক্ষ রেখা এবং কর্কটক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী ২১°৩৬´ থেকে ২১°৫৪´ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৮°৫৪´ থেকে ৮৯°২০´ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। উচ্চতার দিকে বিবেচনা করলে এ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ১৬ ফুট উচুঁতে। জেলার সীমানা যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে তাতে উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ। বর্তমানে এ জেলার আয়তন ৩৮৫৮.৩৩ বর্গ কিলোমিটার। তবে এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সব অংশে জনবসতি নেই। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মধ্যে যে পরিমাণ ভূমি তার পরিমাণ ১৪৪৫.১৮ বর্গ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে তাকালে এ জেলার পূর্বে খুলনা জেলা, পশ্চিমে চব্বিশ পরগণা জেলার (ভারত) বসিরহাট মহকুমা, উত্তরে যশোর জেলা ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
সাতক্ষীরা জেলার ভূ-প্রকৃতির অধিকাংশই সমতল, অল্প কিছু ভূমি অসমতল। জেলার ভূ-প্রকৃতিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন ভূ-প্রকৃতিবিদগণ। এগুলো- ১) গাঙ্গেয় পলল ভূমি ২) মিশ্র গাঙ্গেয় পলল ভূমি এবং ৩) গাঙ্গেয় কটাল পলল ভূমি।
জেলার মাটির গঠন প্রকৃতি উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে দু’রকমের উঁচু। এখানে সাধারণত শস্যের ফলন ভাল হয়। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি লোনা ও এঁটেল। সমুদ্রের সাথে এ অঞ্চলের নদীগুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণে নদীগুলো বয়ে আনে লবণাক্ত পানি। জোয়ার ভাটার কারণে এই লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয় দক্ষিণাঞ্চলের জনপদ। এ অংশে শস্যের ফলন অপেক্ষাকৃত কম। বর্তমান ভেড়ীবাঁধ দিয়ে ব্যাপক হারে মাছের চাষ করা হচ্ছে।
উল্লিখিত দু’প্রকারের ভূমি ছাড়াও সাতক্ষীরা জেলায় নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানি বিধৌত হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি ও ক্ষয়ের প্রক্রিয়া সচল। এই প্রেক্ষিতে দক্ষিণাঞ্চলে নদীর পলি ও পচনযুক্ত কালো উদ্ভিদের সংমিশ্রণে এক প্রকার মাটি সৃষ্টি হয়েছে। এর নাম জোব মাটি। বিশেষ উন্নত অবস্থায় পৌছানোর পর এ মাটিতে ভাল ফসল জন্মে।
সাতক্ষীরা জেলার জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্ভূক্ত। এখানে শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ও গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রচুর মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয়। মৌসুমী বায়ুর কারণে জেলায় বৃষ্টিপাতের হার অপেক্ষাকৃত অধিক।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নানা ধর্মাবলম্বী, নানা পেশার, নানা ভাষার লোক বিভিন্ন সময়ে সাতক্ষীরা নামের জনপদে তাদের বসত গেড়েছেন। সঙ্গত কারণেই তাদের কিছু কীর্তির ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে এখানে। সংরক্ষণের অভাব, ঐতিহাসিক নিদর্শন ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার, লবণাক্ত আবহাওয়া, ধ্বংস ইত্যাদি কারণে বহু প্রাচীন নিদর্শন আজ বিস্মৃতির অতলে, তবু এখনো যে নিদর্শনসমূহ টিকে আছে তা দেখে ও তার ইতিহাস ঘেটে নির্দ্বিধায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের প্রাচীনতম নিদর্শনসমূহের পাশাপাশি অতি সহজেই এ প্রাচীন কীর্তিসমূহ স্থান লাভের যোগ্য।

[সূত্রঃ সাতক্ষীরা জেলা তথ্য বাতায়ন]

Related Posts

হোম সাতক্ষীরা, একটি স্বপ্নের শুরু

এডমিন ডেস্ক থেকে   হোম সাতক্ষীরা একটি স্বপ্ন, একটি স্বপ্নযাত্রার সূচনা । আমরা (আপনি সহ)Read More

Beautiful Bangladesh, School of Life

বিউটিফুল বাংলাদেশের নেপথ্য কাহিনি (গতকালের প্রথম আলো থেকে) বাংলাদেশকে নিয়ে একটি প্রামান্য চিত্র তৈরী হবে।Read More

সাতক্ষীরা আমার অহংকার

রোজ বাবু ( @rosebabu ) ভাইয়া আমার একটা ম্যাসেজের প্রতিউত্তরে যেটি লিখেছেন তার অনুমতি নিয়েRead More

6 Comments to সাতক্ষীরা জেলার পটভূমি ও ইতিহাস

  1. Dohnnobad for tickling my ignorance!
    Just to have an idea… I tryed:
    http://www.indianetzone.com/23/the_sena_dynasty.htm
    (one cannot copy text directly… but I found a little trick)

    Well, you are right. The alphabet is not enough. I have still to study your History.
    OK: Uncle Dino wants to start immediately!!! Here my first homework, dear teacher Asma!

    The Sena Dynasty ruled Bengal in the 11th and 12th centuries. Origin of Sena Dynasty, however, is not known clearly. They covered much of the north-eastern region in the Indian Subcontinent. After the Palas they proved to be a major boon to the History of Bengal. The Senas belonged to the Gaur Kayastha sub-caste of the Chitraguptvanshi Kayastha. Hemanta Sen, was the founder of this dynasty who was part of the Pala dynasty till their empire began to weaken. He seized power and styled himself as king. Under the rule of Sena dynasty Bengal also witnessed a major cultural development.

    His successor Vijay Sena helped laid the foundations of the Sena dynasty, and reigned for long period. Gaur was captured by Vallalsena from the Pala and became the ruler of Bengal and Delhi as well as made Nabadwip the capital. The reign of Vallalsena was mainly noted for peace and social reform. Vallalsena conquered the territories of Magadha and Mithila and consolidated the kingdoms conquered by his father. He was a patron of art and culture. His reign was marked with cultural resurgence. Lakshman Sen succeeded Vallalsena. He expanded the Empire to Assam, Orissa, Bihar and probably to Varanasi also. In the Turkic general Bakhtiyar Khilji attacked Nabadwip, he was unable to conquer Bengal.

    The Sena rulers were Hindus due to which Buddhism that had dominated Bengal was in decline. The Sena dynasty built Hindu temples and monasteries including the famous Dhakeshwari Temple which is now in Dhaka, Bangladesh. They were also great patrons of literature. Bengali Literature witnessed a major growth during the rule of Sena dynasty. Some Bengali authors believe that Jayadeva, the famous Sanskrit poet and author of Gita Govinda, was one of the Pancharatnas in the court of Lakshman Sen.

    Vishwarupa Sena and Kesava Sena were successors of Lakshmana Sena who ruled for more than a half century. Vishwarupa, son of Lakshmana Sena ruled Eastern Bengal. He successfully repulsed invasion of Eastern Bengal by the Muslims. His brother Kesava Sena carried on the legacy. He is the last known ruler of Sena dynasty.

    After the Sena dynasty, the Deva dynasty ruled in eastern part of Bengal. The Sena rule constitutes an important landmark in the history of Bengal. The Sena period saw a great development in Sanskrit literature also. Brahmanical Hinduism revived in Bengal during this period.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.