সাতক্ষীরায় মৌলবাদীদের আঘাত কেন বার বার ?

অতি সম্প্রতি আমাদের প্রিয় সাতক্ষীরায় ঘটে গেলো এক নারকীয় তান্ডব। ২০১২ তারিখের ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফতেহপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশিষ্ট বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদের ছোটগল্প ‘হুজুর কেবলা’ থেকে রচিত নাটক মঞ্চস্থ করে। এই গল্পটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কোর্সে বাংলার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সুতরাং বলাই যায় সরকার বা সরকার নিয়ন্ত্রিত পাঠ্যবই নির্ধারন কমিটি এই গল্পে কোন ক্ষতিকর কিছু পায়নি। স্কুলের ছাত্ররা নাটক মঞ্চস্থ করার তিন দিন পর, ২০১২ সালের ২৯শে মার্চ, বাংলাদেশের মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত সাতক্ষীরার স্থানীয় দুটি সংবাদপত্র দৈনিক দৃষ্টিপাত ও দৈনিক আলোর পরশ নাটকে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সম্পর্কে নিন্দনীয় মন্তব্য করা হয়েছে বলে খবর ছাপে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ওদিকে দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবু জাফর সানপুই কালীগঞ্জ থানায় ৩০শে মার্চ একজন নাট্যকার, প্রধান শিক্ষক ও একজন সহকারী প্রধান শিক্ষককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন, বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননা বা বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিপক্ষে যায় এমন কিছু আয়োজন করা বা বলা খুবই বিপদজনক হয়। করিৎকর্মা পুলিশ প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। একটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যকর্ম যা বহু যুগ ধরে বাংলা ভাষার সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে সেটার নাট্যরুপ ও সে অনুযায়ী নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য তাদের জেলে যেতে হয় ! এ পর্যন্ত হলেও ঠিক ছিলো। কিন্তু না, ঘটে গেছে অনেক অঘটন, অনেক জুলুম, অনেক অমানবিক কর্মকান্ড, ইতিহাস হয়ে থাকবে এক ভয়ানক মানবিক বিপর্যয়।

সাতক্ষীরায় তান্ডব

একদল মুসলিম ও মৌলবাদী মোল্লা শুক্রবার ৩০ মার্চ ২০১২ জুম্মার নামাজের পর সশস্ত্র বিক্ষোভ শুরু করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে। শনিবার, তৌহিদী জনতার ব্যানারে ফতেহপুর গ্রামে প্রতিবেশী এলাকার লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। কারা তারা ? এলাকার মৌলবাদী শক্তি যারা ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দুদের পক্ষে যুদ্ধ বলে তকমা দিয়েছিলো। কৃষ্ণনগর ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন এবং অন্যান্য এলাকার শত শত মানুষ দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের বাইরে জড়ো হয়, নেতারা তাদের সামনে উগ্র বক্তব্য দেয়া শুরু করে। উত্তেজিত ও উগ্র লোকজন সকাল ৯ টার দিকে ফতেহপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও ফতেহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাঠি, লোহার রড ও চাবুক দিয়ে হামলা চালায়। এরপর তারা শাহিনুর রহমান ও তার তিন ভাইয়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাঁশতলা বাজারে তারা ফতেহপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম সরদারের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে মুসলমান জনতা মিতা রানী হাজরা সহ ৭টি হিন্দু পরিবারের ঘর পুড়িয়ে দেয়। তারা ওই বাড়িগুলো থেকে মূল্যবান জিনিসপত্রও লুটপাট করে। একের পর এক গুজব রটানো হয় হিন্দুদের নামে। রবিবার বিকেলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পাশের চাকদহ গ্রামের হিন্দু গৃহবধূ ললিতা সরদার মুহাম্মাদ সম্পর্কে আরেকটি নিন্দনীয় মন্তব্য করেছেন। ললিতা সরদারের বাসভবনে মানুষ জড়ো হতে থাকে, তাদের আচরনে উগ্রতা প্রকাশ পায়। তাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় নাজিমগঞ্জ বাজার কমিটির সভাপতি ফিরোজ কবির কাজল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের নিয়ে পৌঁছান। তারা ললিতাকে তার নিন্দনীয় মন্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে চাপ দিতে শুরু করে। এই বৈঠকের সময় আশেপাশের গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক যুবক তাদের বাড়ির কাছে জড়ো হয় এবং পরিবারকে লাথি মেরে ভারতে পাঠানোর হুমকি দেয়। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার কিশোর ও যুবককে ঘটনাস্থলে ডাকা হয়। চারপাশের গ্রাম থেকে আসা তৌহিদী জনতার ব্যানারে বহিরাগতরা সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়ির আশেপাশে জড়ো হয় এবং তাদের বাড়িতে পাথর ও ইট নিক্ষেপ করতে থাকে। হিন্দু পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা তাদের জীবনহানির ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করে। সন্ত্রাসী কায়দায় হামলাকারীরা তাদের বাড়িঘর ভেঙে দেয় এবং মূল্যবান জিনিসপত্র, গয়না, পোশাক, জমির কাগজ এবং অন্যান্য মূল্যবান দলিল লুট করে। তারা ললিতা সরদারের কাছ থেকে গয়নার বাক্সও ছিনিয়ে নেয়। নিরাপদে লুটপাট করার পর দুর্বৃত্তরা পেট্রল দিয়ে ঘরগুলো পুড়িয়ে দেয় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ টি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে কিন্তু স্থানীয় ও জেলা থেকে নিয়োজিত রিজার্ভ পুলিশ ছিলো অথচ পুলিশের উপস্থিতিতেই লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুরোপুরি পুড়ে না যাওয়া পর্যন্ত দমকল বাহিনীকে এলাকায় প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। এভাবে পুড়ে যায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি, লুটপাট হয় তাদের সম্পদ, তারা আগেই প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে। শোনা যাচ্ছে, কেউ কেউ প্রাণভয়ে দেশের সব ফেলে সীমানা পেরিয়ে ভারতে তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছে।

এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভুক্তভোগী সন্ত্রস্ত ভাবে দিন কাটাচ্ছে, অনেক পরিবারের সদস্যরা তাদের বাড়িতে ফিরে আসেনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো মূলধারার বাংলাদেশী গণমাধ্যম এই ঘটনায় সম্পূর্ণ নীরবতা বজায় রাখে। দেশের সুশীল সমাজও চুপচাপ। সরকার ব্যর্থ হয়েছে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে। কিন্তু সাতক্ষীরা সন্তানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, সাতক্ষীরার মানুষের অংশগ্রহনে সচল হোম সাতক্ষীরা এই মানবিক বিপর্যয়ে নিরব থাকতে পারে না। আমরা এই জঘন্য ও পৈশাচিক বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানাই। সংখ্যালঘুদের পূর্ণ অধিকার আছে এই দেশে তাদের জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার। এ দেশ সবার, সংখ্যালঘুদেরও। তাদেরও আছে কথা বলার, ধর্ম-কর্ম করার, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালানোর অধিকার। এই দেশে বারে বারে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমন চালানো হয়, এই সাতক্ষীরাতে এর আগেও ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাড়-বাড়ন্ত ও নিষ্ঠুরতা দেখা গেছে। আর কতো ? সচেতন মহলের এখন একটু সজাগ হওয়ার সময়।

আমরা হোমসাতক্ষীরা পরিবার সম্মিলিতভাবে ফতেহপুর গ্রামে গিয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে থাকতে চাই। আমরা সবসময় নিপিড়ীত মানুষের পক্ষে আমাদের অবস্থান পূর্ণব্যক্ত করে যাবো। মৌলবাদী অপশক্তিকে পরোয়া না করে মানবিকতার পৃথিবী গড়ার জন্য আমরা সকল মানুষের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাই। সভ্যতাকে ধরে রাখতে হলে, মানুষকে এগিয়ে যেতে হলে মানবিক মানুষের পৃথিবী দরকার। আমরা মৌলবাদী অপশক্তিকে আবারো নিন্দা জানাই।



Related Posts

বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের টুকরো কিছু গল্প

হুমায়ুন কবির মিন্টুর লেখা থেকে। এশিয়া কাপ শুরুর আগে এই ম্যাচটা দেখার আগ্রহ ছিল অনেকRead More

বিজয়ের ৪০ তম বছরের এই বিজয়ের মাসে একজন খগেন্দ্রনাথ মন্ডলের চলে যাওয়া!

সাইটে ঢুকেই চোখে পড়ল হাসমত ভাইয়ের এই লেখাটি। উনি লেখাটি লিখেছেন আজকের প্রথম আলোর একটিRead More

একটি সতর্কীকরন, dolancer.com থেকে দূরে থাকুন

আমাদের দেশের মানুষ বোকা কিনা জানিনা তবে বার বার ঠকেও তারা কেন শেখে না? কতRead More

One Comment to সাতক্ষীরায় মৌলবাদীদের আঘাত কেন বার বার ?

  1. বেশী পাখা গজাইছে শালাদের। এক্কেবারে খাঁড়া পুতে ফেলবো। তোদের ঘড়বাড়িও জালায়ে দেবো মুনাফেকের দল। আল্লার নবীর নামে কেউ কটাক্ষ করলে তাকে পাসপোর্ট ছাড়াই জাহান্নামে পাঠানো হবে। এটা আল্লার জমিন, এখানে আল্লার আইন চলবে, তোদের মতো তাগুতের বিধান নয়। তোদের পালের গোদা কে ? সাইফুর রহমান নামের কেউ, তাইনা ? তার সন্ধান দে, জাহান্নামে পাঠানোর ব্যবস্থা করি আগে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.